বাজেটে ই-কমার্সে ভ্যাট আরোপ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বাধা সৃষ্টি করবে

টেকআলো প্রতিবেদক:
অনলাইন পণ্য ও সেবা বিক্রয়কে জাতীয় ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা ২০১৮ ও বাংলাদেশ গেজেটে (জানুয়ারি ৩১, ২০১৯) প্রকাশিত সংজ্ঞা অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত করে আলাদা সার্ভিস হিসাবে বিবেচনা করা এবং নতুন সেবা কোড বরাদ্দ দেয়ার জন্য অনুরোধ করে পূর্বের এস আর ও (S০৯৯.৫০) বহাল রেখে বরাবরের মতো ই-কমার্স খাতের ওপর প্রস্তাবিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে এই খাতের জাতীয় সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)। সংগঠনটির দাবি, এই ভ্যাট প্রত্যাহারের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ক্রয়-বিক্রয়ে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ও ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াবে। সর্বোপরি এই ভ্যাট ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে বাধা সৃষ্টি করবে। মঙ্গলবার রাজধানীর কাওরানবাজারস্থ “লা ভিঞ্চি” রেস্তোরায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই দাবি করা হয়। এসময় আজকের ডিল, বাগডুম, রকমারি, দারাজ, চালডাল, পাঠাও, সেবা এক্সওয়াইজেড, দিনরাত্রি, সিন্দাবাদ, প্রিয়শপ ডটকম প্রতিনিধিরা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে অনলাইন মার্কেটপ্লেসের ওপর আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারে ঐকমত্য প্রকাশ করেন। সম্মেলনে জানানো হয়, ইতিমধ্যেই ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিবৃন্দ এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আইসিটি বিভাগ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে একাধিকবার বৈঠক করে বাজেটে ই-কমার্স এর সংজ্ঞা পরিবর্তন, ভুল সংশোধন এবং অনলাইন মার্কেটপ্লেসের উপর আরোপিত ভ্যাট অব্যাহতি সহ বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। ই-ক্যাব এর প্রস্তাবনার উপর সম্মতি জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং আইসিটি বিভাগ থেকে দুটি অফিসিয়াল চিঠি এনবিআরের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়েছে। ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সারের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো: আব্দুল ওয়াহেদ তমাল, অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল হক সহ ই-ক্যাব কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য ও পরিচালকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। সভাপতির বক্তব্যে শমী কায়সার বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে ব্যবসায়ের ডিজিটাল রূপান্তরের কোনো বিকল্প নেই। সময় ও দূরত্বের বাধা দূর করে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরি করতে ই-কমার্স এখন সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয়। সবে মাত্র বিকশিত হতে শুরু করায় এটি সরকারের একটি লাভজনক সেক্টর হিসেবেও বিবেচিত। এমন সময় ফেসবুক ও গুগল-এর মতো প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনতে গিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ডিজিটাল ব্যবসায়ের ওপরেও সাড়ে সাত (৭.৫%) শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কেবল ব্যবসায়ের ডিজিটাল রূপান্তরই বাধাগ্রস্ত হবে না, উদ্যোক্তাদের ওপর দ্বৈত বোঝাও চাপিয়ে দেয়া হবে। একইসঙ্গে ডিজিটাল রূপকল্প বাস্তবায়নও হুমকির মুখে পড়বে। প্রতিবেশীদেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও ই-কমার্স খাত প্রাথমিক পর্যায়ে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছিলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনো অনেক দেশেই ই-কমার্সে ভ্যাট নেই। তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকারের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের মাধ্যমে গত বছর কয়েক হলো কেনা-কাটায় ভোক্তারা ডিজিটাল সুবিধায় অভ্যস্ত হতে শুরু করেছিলো। সরকারের উৎসাহ উদ্দীপনায় চলতি বছরে দেশজুড়ে ৮টি বিভাগে ই-কমার্স ডাক মেলার মাধ্যমে আমরা ডিজিটাল ব্যবসা শহরের বাইরেও প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে দিনান্ত কাজ করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু প্রস্তাবিত ভ্যাট আরোপে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিদ্যমান যে দূরত্ব ঘুচতে শুরু করেছিলো তাও বাধাগ্রস্ত হবে। থমকে যাবে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ। বেকারত্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও নারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনা আতুর ঘরেই মৃত্যু বরণ করবে। ই-কমার্স খাতে ভ্যাট সরকারের ডিজিটাল সেবা খাত বিকাশে বাধাগ্রস্ত করবে উল্লেখ করে ই-ক্যাব সেক্রেটারি মোহাম্মাদ আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বেলেন, “আমরা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে দীর্ঘ মেয়াদে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখার দাবি জানাচ্ছি।” ই-ক্যাব সেক্রেটারি বলেন, আমরা সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগের সঙ্গে এক মত। কিন্তু তাই বলে বৃহত্তর স্বার্থে স্বল্প মেয়াদী আয়ের বিনিময়ে নয়। এ কারণেই আমরা ই-কমার্সের সংজ্ঞাকে পরিষ্কার করতে চাই। যাদের ফিজিক্যাল কোনো স্টোর নেই, কেবল অনলাইনেই পণ্য বিক্রি করেন শুধু সেসব প্রতিষ্ঠানকেই ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখার দাবি জানাই। কেননা অনলাইন ব্যবসায় করেন তারা বাজার থেকে পণ্য কেনার সময়ই একদা ভ্যাট দিয়ে থাকেন। এরপরও যদি পুনরায় তাদেরকে ভ্যাট দিতে হয় তবে তাদেরকে দুই দফা কর দিতে হবে। আর এই করভার কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপর গড়াবে। অর্থাৎ অনলাইনে পণ্য মূল্য বেড়ে যাবে। তখন কেউ অনলাইনে কেনা-কাটা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। তিনি জানান, ই-ক্যাব আগামী তিন বছরে সারাদেশে আরও ১০ লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে ই-কমার্সের সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার উদ্যোক্তা সরাসরিভাবে জড়িত। ই-কমার্সের উপর প্রস্তাবিত ভ্যাট তাদের সবার জন্যই একটা মারাত্মক ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। শুধু উদ্যোক্তাদের এই খাতে আসলেই চলবে না, গ্রাহকদেরও নিয়ে আসতে হবে। নতুন করে এই খাতের উপর প্রস্তাবিত ভ্যাট উদ্যোক্তা-গ্রাহক উভয়কেই এ খাত থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। তিনি আরও বলেন, “আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রী দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরাও নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করে যেতে চাই। আমরা চাই এই পুরো প্রক্রিয়ার উন্নয়ন। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোও এক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেকটা এগিয়ে। এই খাতে আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে নীতি-নির্ধারকদের ডিজিটাল নীতিমালা নিয়ে কাজ করতে হবে।” সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অনলাইন শপ তথা ডিজিটাল বাণিজ্য ব্যবস্থার সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশজুড়ে অন্তত ৩ কোটি মানুষের কর্ম সংস্থান হবে। দেশের আপামর জনতা ডিজিটাল সেবা গ্রহণে অভ্যস্ত হতে পারবে। ব্যবসায়ের ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে কলসেন্টার, ডেলিভারি, সফটওয়্যার খাতের ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ের উন্নতি হবে। গ্রাম কিংবা মফস্বল থেকেও উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য ও সেবা অনলাইনে ফেরি করে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হবে। এতে করে রপ্তানি ব্যবসায়ের পরিধি আরও বেড়ে যাবে। অনলাইনে কেনাকাটার সংস্কৃতি বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দেশে ব্যবসায় এবং ব্যবসায়ী উভয়েরই স্বচ্ছতাও বেড়ে যাবে। এতে পরোক্ষভাবে রাজস্ব আয় বাড়বে। বস্তুত, অনলাইনে কেনাকাটায় পণ্য বিক্রি, সরবরাহ এবং মূল্য প্রদান ও গ্রহণ সবকিছুই পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াগত ভাবে ডিজিটাল খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। ফলে উদ্যোক্তা যখন বিক্রির জন্য কোনো পণ্য ও সেবা অনলাইনে ফেরি করেন তখন স্বাভাবিক নিয়মেই অর্থের ঘুর্ণায়মানতার মাধ্যমে রাজস্ব খাত সমৃদ্ধ হয়। ফলে উদীয়মান মুহূর্তে এই খাতে ভ্যাট আরোপ করা হলে সাধারণ ক্রেতা আর অনলাইনে পণ্য কিনতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। বিক্রেতারাও লোকসান গুণতে চাইবেন না। তখন এই খাতকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই যে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে তাও ঝুঁকির মুখে পড়বে।